"থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে দেখব এবার জগৎটাকে।" কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাটি পড়েছিলাম ষষ্ঠ শ্রেণীতে। তখন থেকেই ভেবেছিলাম ভারতবর্ষ ঘুরবো। অজানাকে জানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেবো। অচেনাকে চেনার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বো। পরবর্তীতে ঠিক তাই ঘটলো। প্রকৃতির কাছে ধরা পড়লাম। প্রকৃতির টানে বারবার বেরিয়ে পড়ি। গ্রামের মেঠোপথ ধরে সাইকেল নিয়ে। কখনো বা বন্ধুদের সঙ্গে বাইকে প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনা নির্মিত নতুন নতুন রাস্তা ধরে দিগন্তের দিকে। গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে শহরের দিকে ছুটে চলেছি। কখনো বা বাঁশবাগান আমবাগান পেরিয়ে নদীর পাড়ে পৌছায় গিয়েছি। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ডুবন্ত সূর্যের প্রতিকৃতি দেখেছি, ক্যামেরাবন্দি করেছি। প্রকৃতির কাছে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। আজও মনে পড়ে ব্রহ্মোত্তর (আমার গ্রাম) থেকে বাইক নিয়ে রায়গঞ্জের কুলিক পাখিরালয় ভ্রমণ। আবার ছোট ভাইয়ের অনুরোধে সঙ্গে নিয়ে মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারি ভ্রমণ। সুবর্ণ সুযোগটা পেয়েছিলাম যখন আমি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে আলিগড় ইউনিভার্সিটিতে জিওগ্রাফি অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়ে। তারপর উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান দিল্লি, পাঞ্জাব ,হরিয়ানা, কর্ণাটক, কেরালা, তামিলনাড়ু, উত্তরাখণ্ড, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, ইত্যাদি বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং ভৌগোলিক স্থানের ভ্রমণ করি। বিভিন্ন রাজ্যের মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশেছে। তাদের খাদ্য অভ্যাস, আচার-আচরণ খুব কাছে থেকে লক্ষ্য করেছি। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। বৈচিত্র্যপূর্ণ ভারতবর্ষকে খুজে পেয়েছি। তখন অজান্তেই ভ্রমণের নেশাটা আমাকে চেপে বসেছিল। আলিগড় ইউনিভার্সিটি থেকে জিওগ্রাফিতে এমএ বিএড করার পর আজিম প্রেমজি ফাউন্ডেশনে জিওগ্রাফি রিসোর্স পারসন হিসেবে চাকরি পেয়ে যায়। রাজস্থানের মাউন্ট আবুর কাছাকাছি থাকতাম। শিক্ষকদের ট্রেনিং এর সুবাদে বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করি। বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের পাকুড়ে ভারতী এন্টারপ্রাইজের CSR (কর্পোরেট এন্ড সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি) বিভাগে কর্মরত।
আমার সাফল্যের পিছনে অনেক শিক্ষকের অবদান আছে তাদের সকল কেই শ্রদ্ধা এবং সম্মান জানাই।আজকে এমন একজন শিক্ষকের কথা বলবো যিনি প্রতি মুহূর্তে আমাকে সঙ্গ দান করেছেন। ভাল পরামর্শ দিয়েছেন। সৎ উপদেশ দিয়েছেন। আমার জীবনের চলার পথকে সহজ সরল করেছেন।
“কনকনে
ঠান্ডা, গায়ে
মোটা চাদর
মুড়িয়ে স্যারের
সাথে গল্প
চলছিল। মোঃ
জিয়াউল হক,
আমার স্যার,
উনি একটা
বিশেষ ঘটনার
কথা উল্লেখ
করলেন। বললেন,
দারিদ্রতা কোনো
গ্রীস্ম আর
শীত মানেনা,
শুধু খেয়াল
থাকে পেটের
ব্যাথা। এমনি
ব্যাথার কথা
শোনালেন, ঘটনা
কর্ণাটকের এক
জঙ্গলের আদিবাসী
মহিলার। সেদিন
মনে হয়েছিল
আমরা অনেক
সুখে আছে,
সেদিন একটা
খেয়াল আসলো,
আমি কখন
ওই সব
সমাজের সাথে
গিয়ে কথা
বলবো ?”
জিয়াউল হক স্যার
বর্তমান আব্বাসগঞ্জ হাই মাদ্রাসায় ভূগোল বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। শিক্ষক হিসাবে তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি বলতেন ভ্রমণ করলে নিম্নলিখিত উপকারিতা গুলি পাওয়া যায়-১) ভ্রমণ করলে জ্ঞান অর্জন হয়। ২) ভ্রমণ আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে ৩) মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় ৪) নিজেকে ধৈর্যশীল করতে পারা যায়। ৫) মন মানসিকতা সতেজ করা যায়।৭) কাজ করতে আগ্রহ বাড়ে। ৭) নিজেকে সুখি করা যায়। তিনি আরোও বলতেন ভ্রমণ শিক্ষার অঙ্গ ।তিনি খুব ভ্রমণ পিপাসু মানুষ। তার কাছ থেকেই শুনেছি টাইগার হিল ,শুশুনিয়া পাহাড় ,অযোধ্যা পাহাড়, নীলগিরি ,উটি দোদাবেতা ইত্যাদি পাহাড় ও পর্বত চূড়ার গল্প।। তিনি ভারতের সুইজারল্যান্ড শিমলা -মানালি -ডালহৌসি ধর্মশালার ভ্রমণের ছবি দেখিয়েছিলেন । তার কাছ থেকেই মেসেঞ্জার, মাইথন ,কে আর এস বাঁধের অভিজ্ঞতা পায়।তিনি কর্নাটকের বন্দিপুর ন্যাশনাল পার্ক চন্ডিগড় রক গার্ডেন ,দার্জিলিং রক গার্ডেন ,কলকাতা সাইন্স সিটি ইত্যাদির নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনার কাছ থেকেই নর্মদা নদী , শোন নদীর , অর্পা নদীর উৎসের কথা শুনেছি।
গতবছর কলেজ সার্ভিস কমিশন থেকে ইন্টারভিউ দিয়ে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম তখন বিভিন্ন কথার মধ্যে স্যার মেঘালয় ভ্রমণ এর গল্প শুনিয়েছিলেন। মেঘের বাড়ি মেঘালয়।মেঘ পাহাড় ও ঝর্ণার দেশ উত্তর পূর্ব ভারতের মেঘালয় রাজ্য। চারদিকে উঁচু উঁচু সব পাহাড়, (গারো খাসি জয়ন্তিয়া) হাত বাড়ালেই মেঘের স্পর্শ, পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা অসংখ্য ঝর্ণা, স্বচ্ছ পানির নদী, লেক ও ছবির মত সুন্দর গ্রাম, এই সব কিছু মিলেমিশে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য নিয়ে মেঘালয়ের হাতছানি স্যারকে মুগ্ধ করেছিল। মেঘালয়ের রাজধানী শিলং কে বলা হয় প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড। বৃষ্টিছায়া অঞ্চল অপরদিকে বৃষ্টিবহুল চেরাপুঞ্জি গ্রাম। চেরাপুঞ্জি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের স্থান। শিলং থেকে ৫৬ কিঃমিঃ দূরের এই শহরের উচ্চতা ৪২৬৭ ফুট। চেরাপুঞ্জি যাওয়ার পথশোভার তুলনা হয় না। চেরাবাজার ঘিরেই চেরাপুঞ্জি। চেরাগ্রাম ঘিরে রয়েছে কমলালেবু বাগিচা। মাওলাওং গ্রাম ও স্নোংপাডং গ্রাম শিলং থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রামটি তকমা পেয়েছে এশিয়ার সবচেয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসাবে। খুব বেশী কিছু দেখবার এখানে না থাকলেও গাছের উপর তৈরি বাড়ি, মাচার উপর তৈরি বাড়ি, এবং সর্বত্র বাঁশের তৈরি ময়লা ফেলবার ঝুড়ি। প্রাচীন জীবনকাল ও তাতে পরিচ্ছন্নতার চর্চা অনেককিছু শেখায়। বাঁশের তৈরি বেঞ্চ ,শুয়ার আসন, সরু রাস্তার দুই ধারে ফুলের বাগান, দূষণ মুক্ত বায়ুতে বেঞ্চে শুয়ার অভিজ্ঞতা।১০-১৫ মিনিট দূরে সিঙ্গেল রুট ব্রিজ আছে একটি। বিশাল বটবৃক্ষের শিকড় দিয়ে তৈরি রুট ব্রিজ । তার নিচ দিয়ে স্বচ্ছ জলের নদী।রুট ব্রিজ ও নদীর স্বচ্ছ জলের পাশ দিয়ে ভ্রমণকারীদের বিভিন্ন স্টাইলে ছবিতোলা।স্নোংপাডং গ্রামে রয়েছে উমগট নদী। এ রাজ্যে মহিলাদের শিক্ষিতের হার খুব বেশি । মহিলাদের সামাজিক মর্যাদা খুব উন্নত। বেশিরভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য এবং দোকান মহিলারাই চালায়।পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ কন্যা বিয়ের পর বাবার বাড়িতে স্বামীসহ থাকবে।এটাই এখানকার প্রথা।
তিনি 'দিয়ারা ট্যুর ওয়ার্ল্ড ' নামক গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত।এই গ্রুপের কোঅডিনেটার ও গাইড হলেন মো : রাকিউল হক, মো:হাসানুজ্জামান মো: আরমান আলি (শিক্ষক মাজহারুল উলুম হাই মাদ্রাসা) তিনি ভারতের যে স্থান গুলি ভ্রমণ করেছেন তার তালিকা দিলাম - -
১) গৌর মালদা ২)আদিনা মালদা ৩)রায়গঞ্জ কুলিক পাখিরালয় ৪)মিরিক-কালিংপং- দার্জিলিং ৫)কোচবিহার রাজবাড়ি - মাথা ভাঙ্গা-শিতলকুচি ৬)মুর্শিদাবাদ হাজার দুয়ারী - লাল বাগ ৬)তারাকেশ্বর মন্দির ৭)দীঘা ৮)শুশুনিয়া পাহাড় - মুকুটমনিপুর- অযোধ্যা পাহাড়-মুখস গ্রাম (বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া) ৯)বোলপুর শান্তি নিকেতন ১০)কলকাতা ১১)ভাগলপুর ১২)গ্যংটং সিকিম ১৩)পেলিং-সিকিম ১৪)রাজগীর-নালন্দা- গয়া-বৌদ্ধ তীর্থ কেন্দ্র , জৈন মন্দির, বিহার দরগা শরিফ ১৫)শিলং-চেরাপুঞ্জী-গারো খাসি জয়ন্তী পাহাড় - রুটব্রিজ - এশিয়ার পরিস্কারতম গ্রাম (মেঘালয়) ১৬)গৌহাটি শহর, চিড়িয়াখানায়, কাজিরাঙা ন্যাশনাল পার্ক, কামাক্ষা মন্দির (অসম) ১৭)ম্যাসানজোড় বাধঁ ১৮) মাইথন বাধঁ ১৯)রতনপুর, কুটাঘাট ড্যাম, সান্জায় পার্ক, গোলবাজার, রাজীব মার্কেট,অর্পানদী (ছত্তিশগড়) ২০)অমরকন্ট নর্মদানদীর উৎস, জলপ্রপাত ,শোন নদী (মধ্যে প্রদেশ) ২১)শিমলা-মানালি-কুলু-ধমশালা-ডালহৌসি(হিমাচল প্রদেশ) ২২)চন্ডীগড়-জালিয়ানাবাগ-অমৃতসর মন্দির - ওয়াগাবর্ডার (পান্জাব) ২৩)আজমির এবং সাইট সিন (রাজস্থান) ২৪) দিল্লী - লালকেল্ল-ইন্ডিয়া গেট-চাদনীচক মার্কেট, জৈন মন্দির, মেট্রো রেল, জামে মসজিদ ইত্যাদি। ২৫) আগ্রাদুর্গ, তাজমহল, মথুরা, বৃন্দাবন (উত্তর প্রদেশ) ২৬)মায়সুর প্যালেস, টিপুসুলতানের বাড়ি, কবরস্থান, মসজিদ, হত্যাস্থান, KRS Dam(বৃন্দাবন)
, বান্দীপুর ন্যাশনাল পার্ক ( কর্নাটক) 2৭) কোয়েম্বাটুর সাইট সিন, নীলগিরি-দোদাবেতা- উটি, (তামিলনাড়ু) ২৮)কোচি সমুদ্র সৈকত, জুম্মা মসজিদ, সাইট সিন (কেরালা) ২৯) বিশাখাপত্তনম শহর, সমুদ্র সৈকত, ফিল্ম সিটি, আরাকু ভ্যালি, বোরাগুহা, কফি ও চা বাগান (অন্ধ্রপ্রদেশ) ইত্যাদি। ধন্যবাদ।