মিড্-ডে-মিল ব্যবস্থার ইতিহাস খুঁজতে হলে আমাদের ১০০ বছর পিছনে ফিরে দেখতে হবে। রাজ্য হিসেবে আমাদের দেশের অঙ্গরাজ্য তামিলনাড়ু এই ব্যবস্থা শুরু করে ৬০ এর দশকে। অনেকে আবার বলে থাকেন যে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বেও অনেক জায়গায় এই ব্যবস্থা ছিল। যাইহোক, ২০০২ সালে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সারা দেশে এই ব্যবস্থা ৬ মাসের মধ্যে লাগু করার কথা বলা হয়। প্রথমে অনেক রাজ্যে চাল, গম এই সব বন্টন করা হলেও পরে সেটা কুকিং ফর্মে লাগু হয়। এইরকম ইতিহাস ইন্টারনেটে খুব সহজে বিস্তারিত পেয়ে যাবেন। আসল কথায় আসছি। ..
মে, ২০১৪ সাল, আজিম প্রেমজি ফাউন্ডেশন ক্যাম্পাস প্লেসমেন্ট এর জন্য আসে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি তখন মাস্টার ডিগ্রী ফাইনাল সেমেস্টার। একটা কমন সেশান করা হয় সেখানে সেই সংস্থার কিছু লোক আমাদের সাথে কথা বলেন এবং আহ্বান করেন যে "ইফ ইউ ওয়ান্ট টু কান্ট্রিবিউট ইন গভর্ণমেন্ট এডুকেশন সিস্টেম দেন জয়েন আস, জয়েন আজিম প্রেমজি ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট।"
২০১২ তে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এড করেছিলাম, তাজা তাজা মনোভাব, সবকিছু বদলানোর প্রবল ইচ্ছা তাই আজিম প্রেমজি ফাউন্ডেশনের কথা গুলো একদম মনে অনেক সাড়া দেয়। একটা কথা বলে রাখা ভালো, আপনি বি.এড কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করুন বা যেকোনো কলেজ থেকে, প্রফেসর গুলো বেশিরভাগই স্কুলের সত্যিকারের পরিবেশ সম্পর্কে অবগত থাকেন না, আদর্শগত দিক আর থিওরী নিয়ে দিব্বি কাজ চালিয়ে যান। যাইহোক, এই সংস্থায় জয়েন করার জন্য পরীক্ষা দিলাম এবং কয়েকদিন পর জানতে পারি যে সাক্ষাৎকারের জন্য ভূগোল বিষয়ের কয়েকজনকে সিলেক্ট করা হয়েছে। সেই রকমই অন্যান্য বিষয়েও হয়েছিল। আজিম প্রেমজি ফাউন্ডেশনের সাক্ষাৎকার বা ইন্টারভিউ একটু আলাদা রকম কারো ৩০ মিনিট তো কারো ১ ঘন্টাও চলে। ইন্টারভিউ দিয়ে একটা তৃপ্তি পাওয়া যায়। যারা এই প্রসেস দেখেছে তারাই শুধু এই অনুভব করতে সক্ষম। প্রথম রাউন্ডের ইন্টারভিউ বিষয় সম্বন্ধিত এবং দ্বিতীয় রাউন্ড "পার্সপেক্টিভ অফ এডুকেশন" এর। দ্বিতীয় রাউন্ডে আমাকে অনেক প্রশ্ন করা হলেও একটা প্রশ্ন আমার খুব ভালো ভাবে মনে আছে,
"বর্তমানে মিড্ ডে মিল্ ব্যবস্থার উপর আপনার মতামত কি ?"
আমার উত্তর অনেক নেগেটিভ ছিল, সোজা জানিয়েছিলাম যে এই সিস্টেম তুলে দেওয়া উচিত। কারণ এই ব্যবস্থা স্কুলে একটা খারাপ প্রভাব ফেলছে। তখন প্রশ্নকর্তা মুচকি হেসে আবার প্রশ্ন করেন, কোন ধরণের খারাপ প্রভাব ? এবং আমি অনেক এদিক ওদিক বলেছিলাম।
যাইহোক বেশ কয়েকদিন পর জানতে পারি যে আমি সিলেক্ট হয়েছি, লোকেশন দেওয়া হয়েছে রাজস্থান। সংস্থা জয়েন করার ১ বছর পর জানতে পারি মিড্ ডে মিল প্রকৃত মানে এবং জানতে পারি প্রশ্নকর্তার সেই মুচকি হাসির কারণ। আমাকে কিছু জেদী শিক্ষক-শিক্ষিকা সাহায্য করেছিলেন এই ব্যবস্থাকে জানতে। একজন শিক্ষক 'শঙ্করলাল বুনকার' (প্রধান শিক্ষক, সেকেন্ডারি স্কুল মালিপুরা, রেওদার ব্লক, সিরোহি জেলা) একটা কথা বলেছিলেন যে, "স্যার মিড্ ডে মিল শুধু দুই মুঠো খাবার নয়, মিড্ ডে মিল্ একটা মূল্যবোধ। শিক্ষার আল্টিমেট উদ্দেশ্য হলো, একটা কর্তব্যপরায়ণ নাগরিক তৈরী করা। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ন্যায়, লিবার্টি, ভাতৃত্ববোধ এই সব মূল্যের কথা বলা হয়েছে। আর এই মিড্ ডে মিল ব্যবস্থা আমাদের এই সংবিধানিক মূল্যবোধ তৈরী করে। যখন ছাত্র ছাত্রী দুই মুঠো খাওয়ার সময় একসাথে বসে তখন একটা সমানতাবোধ, ভাতৃত্ববোধ এই সব গুন্ ফুটে ওঠে।" শঙ্করলাল স্যার এই মিড্-ডে-মিল ব্যবস্থার উপর আজিম প্রেমজি ফাউন্ডেশনের টেকনিক্যাল সাহায্য নিয়ে একটা দারুন ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন যেটা সারা রাজ্যের (রাজস্থান) অনেক জেলায় ইনসার্ভিস টিচার্স ট্রেনিং এর সময় দেখানো হয়েছিল। সেই সময় উনাকে অনেক আলোচনা শুনতে হয়েছিল কারণ উনার ব্যবস্থাটা সবার ক্ষেত্রে ডিসকম্ফোর্টপ্লেস তৈরী করছিলো।
সত্যি, আমাদের দেশে অনেক সেই রকম জেদী শিক্ষক শিক্ষিকা আছেন যারা ছাত্র ছাত্রীদের অধিকারের জন্য নিজের আরামদায়ক কেদারার তোয়াক্কা পর্যন্ত করেন না, ছাত্র ছাত্রীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে নিজ লোকেদের সাথেও লড়াই করতে পিছু হটেন না। এই মিড্-ডে-মিল্ প্রভাব স্কুল ছুট কমানো থেকে, স্কুলের উপস্থিতি সব জায়গায় প্রলক্ষিত। কোবিড-১৯ লকডাউনে এর প্রভাব সবজায়গায় দেখতে পাওয়া গিয়েছিলো। এই অন্যতম ব্যবস্থার সঠিকভাবে মনিটরিং বা উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে অনেক স্কুলে বাধার সম্মুখীন হয়েছে এটাও সত্য। অনেক জায়গায় এই ব্যবস্থাকে সঠিক বললেও অনেক শিক্ষক শিক্ষিকা একটা চ্যালেঞ্জ বা বাধা হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন। আবার অনেক বিদ্যালয়ে এই সামান্য খাবারটুকুও শিক্ষক শিক্ষিকা, এস.এম.সি মেম্বার, শিক্ষা দপ্তরের অফিসার সবার মধ্যে বন্টন হয়ে যায়।
***
.jpg)
