Monday, June 6, 2022

শিক্ষা ব্যবসা আর কোবিড-১৯

সাল ২০১৯, জাতীয় স্তরের খবরের চ্যানেল থেকে খবর ধেয়ে আসছিলো, যে বিশ্বের বেশ কয়েকটা দেশে কোবিড ভাইরাস থাবা বসিয়ে দিয়েছে। আমাদের দেশে তখন লোকসভা ভোট নিয়ে মাতামাতি, যেটা হয়েই থাকে। তারপর জানুয়ারি ২০২০, আমাদের দেশেও অবশেষে ঢুকলো সেই অভিশাপ "কোবিড-১৯", তারপর শুরু হয় তান্ডব। দেশের সমস্ত রকমের ব্যবস্থাকে এক এক করে নগ্ন করতে থাকে এই কোবিড ভাইরাস। জর্জর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, নড়বড়ে এবং অভিশপ্ত শিক্ষা ব্যবস্থা, রক্তে রাঙানো যাতায়াত ব্যবস্থা, মারণ রাজনীতি, কুসংস্কারে ঢাকা আমাদের চিন্তাধারা, ধর্মের নামে বিদ্বেষ, সবকিছুই আয়নার মতো আমাদের সামনে আসতে থাকে।

২০২০ এর শেষের দিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা ব্যবস্থা (ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা) যেমন ধীরে ধীরে সম্পন্ন ব্যক্তিদের কম্পিউটার এর ভিতরে প্রবেশ করলে লাগলো ঠিক সেই সময় গরিবদের হাত থেকে বেরিয়ার যাওয়ার মতো অবস্থা আর মধ্যবিত্তের জন্য এটা হয়ে উঠলো "মোবাইল বেসড" শিক্ষা। শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে উঠলো "অনলাইন", একটি ইংরেজি শব্দ, সবাই শিখলো। আসলে কি জানেন, এটা কোনো ব্যবস্থার শ্রেণীতেই পড়েনা কারণ, বেশির ভাগ (৫০% এর বেশি) দুই মুঠো খাবারের জন্য লড়াই করছে আর ১০-২০% এর জন্য একটা রোগা জীর্ণ, অর্ধ-নগ্ন ব্যবস্থা বানিয়ে বলে দেওয়া হলো যে "ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা এখন দ্রুততার সাথে অনলাইন হয়ে যাচ্ছে, ছেলে মেয়েরা আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করছে।"
ঝাড়খণ্ডের এক আদিবাসী, হয়তো শিক্ষা টিক্ষা বোঝেন না কিন্তু উনি আমাকে মনে করালেন এবং বললেন "দেখুন এই সব শিক্ষা আপনাদের হতে পারে, আমাদের ছেলে মেয়ের জন্য নয়। আমার ছেলে / মেয়ে প্রতিদিন এক নোংরা পরিবেশের সম্মূখীন হচ্ছে আর আপনারা এই ব্যবস্থাকে "অনলাইন শিক্ষা" বলছেন ? আমাদের বোকা বানাবেন না, তাহলে এই সব স্কুল এর দেওয়াল গুলো রেখে কি লাভ ? কোথায় পাবো প্রতিদিন ২-৩ জিবি ডাটা শুধু ভিডিও দেখার জন্য? শিক্ষা তো বিনামূল্যে, এই সময় তো আমাদের মাঠে ঘাটে কোনো কাজ নেই তাহলে পাবো কোথায় নতুন মোবাইল কিনে দেওয়ার মতো অর্থ ?
জানেন ব্যাপারটা আসলে কি? গোবিন্দা এবং শক্তি কাপুর অভিনীত এক হিন্দি সিনেমা "জিস দেশমে গাঙ্গা রেহতা হে" যেখানে একটা দৃশ্য দেখানো হয়েছে যে হঠাৎ করে গ্রামের ধুতি পাঞ্জাবি পড়া লোকটাকে যখন সুট প্যান্ট ধারণ করতে বলা হয় তাও আবার অর্ধ নির্দেশ দিয়ে তখন কোনটা সামনের দিক আর কোনটা নিতম্ব ঢাকার অংশ সেটা বুঝতে অনেক অসুবিধা হয়ে যায়। বাকিটা বুঝতেই পারছেন...!!!
সরকারি তথ্য অনুসারে আমাদের দেশে ২৬০ মিলিয়ন মানে ২৬ কোটি ছাত্র ছাত্রী, ১৫ লক্ষের বেশি বিদ্যালয় এবং ১ কোটির বেশি শিক্ষক শিক্ষিকা এর এই তথ্যের ৯০% লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলো ভালো শিক্ষা দেওয়ার জন্য, শিক্ষা পাওয়ার জন্য। বিপরীত দিকে এক বিশাল সাম্রাজ্য তৈরির পথে সমস্ত ডিজিট্যাল শিক্ষা দেওয়ার ঠিকাদার। প্রতিটা ঘরে ঘরে আমাদের সিনেমা জগতের স্টার বার বার এসে আমার আপনার মাথায় ঢোকাতে ব্যস্ত, 'যে আপনার ছেলে মেয়ের ভবিষৎ আমাদের হাতে দিয়ে দিন।' এমন এক ব্যবসা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় যেটাকে শিক্ষা ব্যবসা বলা যেতে পারে। এই এডটেক কোম্পানি গুলোর ২০১৯ সালে মোট রেভিনিউ ছিল মোটামুটি ৪০০০ কোটি টাকা, এবং ২০২০ সালে এটা এসে দাঁড়ায় মোটামুটি ৩৫,০০০ কোটি টাকায়। ২০২১ সালে এই সংখ্যা আকাশ ছোঁয়ার দিকে মোটামুটি ৫০,০০০ কোটি টাকা। মনে রাখা ভালো এই সময় সমাজের এক বৃহৎ শ্রেণী ২ বেলা খাবারের জন্য সরকারি দপ্তরের উপর তখন নির্ভরশীল। অর্থনীতিবিদরা অনুমান করেন যে, এই রেভিনিউ ২০২৫ সালে ২ লক্ষ ৫০ হাজার কোটিতে গিয়ে দাঁড়াবে।
চারদিকে হাহাকার, সব কিছু ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের জন্য খুললেও স্কুল অনেক পরে খোলা হয়েছিল আর এইভাবেই আমরা বিশ্বের তিন নম্বর সর্বাধিক স্কুল বন্দ রাখার দেশের শ্রেণীতে নাম তুলে ফেললাম। ধীরে ধীরে সরকারী বিদ্যালয় এবং অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়ায়ে লড়ে যাওয়া প্রাইভেট স্কুল গুলো যখন উন্মুক্ত হতে থাকে তখন কিন্তু টেলিভিশন গুলোতে এই "এডটেক" বা "ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবসার" বিজ্ঞাপন অনেক বাড়তে থাকে।
"ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবসার মালিকদের কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু হয়। এই সময় চারদিক থেকে অনেক অভিযোগ আসতে থাকে যে শিক্ষার নামে প্রতারণা, অটো ডেবিট সিস্টেমের মাধ্যমে মধ্যবিত্তের পকেটে ছুরি মারা আরো অনেক ধরণের অভিযোগ।
এখন ক্লাসরুম শিক্ষা ব্যবস্থা আবার নিজ ছন্দে। "ধারাবাহিক শিক্ষা" আর "এডটেক শিক্ষা ব্যবসার" মধ্যে বর্তমান ঠান্ডা যুদ্ধ। ব্যবসায়ীরা সুযোগের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে, আর অর্থিনীবিদরা আবার নতুন করে আর্থিক রেভিন্যুইয়ের অংকে ব্যস্ত।

ফাইল ফটো