আমাদের দেশে "ভালো স্কুল এবং গুণগত শিক্ষা" এর বিষয়টা অনেক সময় থেকেই একটা আলোচ্য বিষয় হিসেবে দেখা হয় বিশেষ করে ১৯৮৬ সালের নতুন শিক্ষা নীতির পর। প্রতিটা স্বচেতন অভিভাবকের মনে প্রশ্ন থাকে আমরা কখন কোনো বিদ্যালয়কে "ভালো বিদ্যালয়" এবং কোন শিক্ষাকে "গুণগত শিক্ষা" বলবো ? ভালো সুন্দর ড্রেস কোড, ভালো বিল্ডিং বা ইনফ্রাস্ট্রাকচার, যথেষ্ট শিক্ষক শিক্ষিকা, পর্যাপ্ত পরিমান ক্লাসরুম ইত্যাদি জিনিসগুলো একটা ভালো স্কুল তৈরিতে সাহায্য করে। কিন্তু একটা ভালো স্কুল এবং গুনগত শিক্ষা কখন বলবো সেটা আলোচনা করা যাক।
প্রত্যেকটা দেশ বা সমাজ কেমন হবে সেটা ব্যক্তিবিশেষে আলাদা আলাদা হলেও আমাদের দেশের সংবিধান সেটা অনেক আগেই নির্ধারণ করে দিয়েছে। "সংবিধানের প্রস্তাবনা" পড়লেই আমরা সহজেই বুঝতে পারবো যে আমাদের সমাজ এবং নাগরিক কেমন হবে? আর এই বিদ্যালয়ী শিক্ষা ব্যবস্থাই হলো প্রধান বাহক যা সেই সমাজ বানাতে চেষ্টা করবে। শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য কখনোই ডাক্তার বা টিচার বা ইঞ্জেনিয়ার বা উকিল বানানো নয়। আর এখানে সমস্ত সমস্যা। "লার্নিং আউটকাম ডক্যুমেন্ট ফর প্রাইমারি লেভেল" এবং "লার্নিং আউটকাম ডক্যুমেন্ট ফর এলিমেন্টারি লেভেল" ২০১৭ পরিষ্কার ভাবে বলা হয়েছে যে, "আমাদের অধিকাংশ শিক্ষক / শিক্ষিকারা শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে অবগত নয়।"
আমরা সাধারণত দেখতে পায়, সমাজে অনেক ডাক্তার বা টিচার বা পুলিশ অফিসার তৈরী হলেও "ভালো দায়িত্বশীল এবং কর্তব্যপরায়ণ নাগরিকের" সংখ্যা অনেক কম। এর মূল কারণ হলো "শিক্ষার প্রধান লক্ষ্যকে গৌণ করে দিয়ে, "পেশা" অর্জন করাকে প্রধান মেনে নেওয়া।" তাহলে আমাদের জানা উচিত যে শিক্ষার মূল লক্ষ্য কি? স্কুল শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো এমন নাগরিক তৈরী করা যে "যুক্তিবাদী চিন্তাধারা এবং স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখবে, নিজের তার সাথে অন্যের স্বাস্থ্য এবং ভালো থাকার ব্যাপারে স্বচেতন হবে, সমস্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিজ অংশগ্রহণ করার সাথে সাথে অর্থিক এবং সংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।"
শিক্ষার এই লক্ষ্য প্রাপ্তির বাহন হিসেবে কাজ করবে "জ্ঞান, ইতিবাচক মনোভাব, কার্য করার ক্ষমতা, এবং মূল্যবোধ" আর এই চারটা জিনিস তৈরী করা জন্যই বিভিন্ন "পাঠ্যক্রম", এই পাঠ্যক্রমের দ্বারাই সম্ভব শিক্ষার লক্ষ্য এচিভ করা। সেই পাঠ্যক্রমের আবার বিভিন্ন স্তরে কিছু লক্ষ্য রয়েছে যেমন প্রাথমিক লেভেলে গণিত বিষয়ের লক্ষ্য আলাদা আবার একই বিষয়ের লক্ষ্য উচ্চ প্রাথমিক স্তরে একটু আলাদা সামান্য উচ্চ পর্যায়ের। সমস্ত লক্ষ্য এচিভ করার একটা গুরুত্বপূর্ণ এলিমেন্ট হলো "লার্নিং আউটকাম", এই "লার্নিং আউটকাম" বাচ্চাদের ভিতরে নির্দিষ্ট স্তরের বিভিন্ন কার্যদক্ষতা বা "কম্পেটেন্সি" ডেভেলপ করতে সাহায্য করে। যেহেতু একটা ক্লাসে বিভিন্ন সমস্যার কারণে "লার্নিং আউটকাম" এর উপর নজর দেওয়া হয়না ফলস্বরূপ বাচ্চার ভিতরে বাস্তব জীবনে সেই জ্ঞান ব্যবহার করার মানসিকতা তৈরী হয়না ।
যদি আমরা ক্লাসরুম থেকে বোঝার চেষ্টা করি তাহলে একজন টিচার যদি সঠিক লার্নিং আউটকাম নির্ধারণ করে ক্লাসরুমে পড়ান তাহলে কমপিটেন্সি এবং নির্দিষ্ট বিষয়ের (ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ইত্যাদি) লক্ষ্য প্রাপ্তি সম্ভব হবে। সমস্ত বিষয়ের লক্ষ্য প্রাপ্তি হলেই স্কুল শিক্ষার লক্ষ্য প্রাপ্তি হবে এবং সর্বোপরি একটা সমাজ যেটা সংবিধানে বলা হয়েছে সেটা সম্ভব, সবগুলোই হবে "জ্ঞান, ইতিবাচক মনোভাব, কার্য করার ক্ষমতা, এবং মূল্যবোধ" এর উপর নির্ভর করে।
একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকা যদি শিক্ষার বাস্তব উদেশ্য সম্পর্কে অবগত না থাকেন তাহলে আমাদের সংবিধানে যে সমাজ গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে সেটা কোনোদিনই সম্ভব হবে না।
যখন কোনো স্কুল সেই উপরে উল্লেখিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে তুলে ধরার চেষ্টা করবে এবং শিক্ষার সেই প্রধান লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ভবিষতের নাগরিক তৈরী করার চেষ্টা বা তৈরী করতে সক্ষম হবে সেই স্কুলকে ভালো স্কুল এবং সেই ব্যবস্থাকে "গুনগত শিক্ষাব্যবস্থা" বলা যাবে।
উল্লেখিত শিক্ষার লক্ষ্য প্রাপ্তির জন্য একটা "ভালো স্কুল" নিজ ছাত্র ছাত্রীদের বিচার বিশ্লেষণ করার জন্য যথেষ্ট স্বাধীনতা প্রদানের সাথে জীবন দক্ষতার প্রশিক্ষণ এবং সংবিধানিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করবে সেটা নীতিকথার মাধ্যমে নয় বরং কাজের মাধ্যমে। একটা ভালো স্কুলে লিঙ্গ বা ধার্মিক বা সামাজিক - আর্থিক বৈষম্য থাকতে পারেনা। একটা ভালো স্কুলে শিক্ষক শিক্ষিকার ভিতরে নতুনত্বকে গ্রহণ করার মনোভাব থাকবে। ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার অগ্রগতিকে অনবরত দেখে যথাসময়ে সঠিক অ্যাকশন নেওয়া এবং সেটার বিশ্লেষণ করা এবং অভিবাভবকদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত করা একটা "ভালো স্কুলের" অন্যতম বৈশিষ্ট।
নিচের দেওয়া ইমেজটা দেখলে সহজেই বোঝা যাবে আমাদের ক্লাসরুম টিচিং লার্নিং প্রসেস কিভাবে সংবিধানের প্রস্তাবনার সাথে যুক্ত।
ছবি: ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক ফর স্কুল এডুকেশন (NCF-SE) ২০২৩, পৃষ্ঠা সংখ্যা - ৬০ থেকে।
